সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৭ অপরাহ্ন
এম আই ফারুক আহমেদ, কালের খবর :
সরকারিভাবে নিবন্ধিত ৯ লাখ ২৩ হাজার ৩৩৫টি যন্ত্রচালিত গাড়ি চালানো হচ্ছে লাইসেন্সবিহীন চালক দিয়ে। বৈধ কিংবা অবৈধ চালকদের একটি বড় অংশ নিষেধ না মেনে মহাসড়কে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে।
আতঙ্কিত যাত্রীদের অনুনয় উপেক্ষা করে অনেক চালক গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে অনবরত কথা বলে থাকে। এসব কারণে ঘটে থাকে বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা। এ ছাড়া অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন এবং অতিরিক্ত ট্রিপ দেওয়ার কারণেও সড়কে ঝরছে প্রাণ।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ওই সময়ে পৌনে সাত লাখ গাড়ি চলছিল বৈধ লাইসেন্সধারী চালক ছাড়া। বর্তমানে তা আরো বেড়েছে বলে জানা গেছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা কিংবা ব্যাপক প্রাণহানির পর গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হলে মোটরযান আইন অমান্যকারীদের ধরতে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু পরে তা স্তিমিত হয়ে যায়।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সড়ক পরিবহন খাতে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা আনতে জেল-জরিমানা বাড়ানো এবং নতুন লাইসেন্স পেতে কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি পাসের বাধ্যবাধকতার বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়েছিল গত বছরের ২৭ মার্চ। পরিবহন শ্রমিক নেতাদের আন্দোলনের চাপে এক বছর ধরে এটি ঝুলে আছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০০৯ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল ৯৭ শতাংশ চালক ‘ওস্তাদের’ সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ করে গাড়ি চালানো শেখে। তাদের মধ্যে শতকরা ১৩ ভাগ নিরক্ষর, ৪৭ ভাগের প্রাথমিক শিক্ষা এবং ৪০ ভাগের এর চেয়ে বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে। পরীক্ষা না দিয়েই লাইসেন্স নেয় ৬১ শতাংশ চালক। টিআইবির ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত রেজাউল করিম তাঁর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে কালের খবরকে বলেন, ওই চক্রের মধ্যেই আছে চালকরা, তাই পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হতো।
জানা গেছে, গাড়ির মালিকরা কম বেতনে ও নিয়োগপত্র ছাড়া গাড়ি চালাতে কম শিক্ষিত ও অসচেতন চালকদের ওপরই নির্ভর করছেন। অদক্ষ চালকদের বেপরোয়া চালনায় এক দুর্ঘটনায় বহু মানুষের প্রাণ ঝড়ছে। যেমন ২০১৪ সালের ২০ অক্টোবর হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কে ৩৭টি প্রাণ নিভে যায় তিন বাসচালকের দোষে। দুর্ঘটনার পর পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি জানতে পারে, ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী কেয়া পরিবহনের বাসটির ছিল না ফিটনেস সনদ ও রুট পারমিট। নাটোর-গুরুদাসপুর পথে চলাচলকারী অথৈ পরিবহনের বাসটির নিবন্ধনই ছিল না। অথৈ পরিবহনের বাসের চালক আলম মণ্ডলের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। গত ২৯ মার্চ সিলেট থেকে হবিগঞ্জগামী একটি বাস নবীগঞ্জে খাদে পড়লে তিনজনের প্রাণহানি ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, চালক বেপরোয়া গতিতে বাসটি চালাচ্ছিল।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন কালের খবরকে বলেন, ‘উপযোগী আইন না থাকা এবং অভিযানের জোর কমে আসায় লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর হার আগের চেয়ে বেড়েছে। গতিসীমা না মেনে গাড়ি চালানো ঠেকাতে ডিজিটাল জরিমানার ব্যবস্থা রেখে একটি প্রকল্প প্রস্তাব আমরা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি।
বিআরটিএ থেকে গত ১ এপ্রিল পাওয়া তথ্যানুসারে, দেশে ২০ ধরনের ৩৩ লাখ ৮২ হাজার ২৪৭টি গাড়ির নিবন্ধন আছে। আর ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮৫২টি। তাতেই ধরা পড়ে ৯ লাখ ২৩ হাজার ৩৩৫টি নিবন্ধিত গাড়ি চালানোর বৈধ চালক নেই। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮৫২টি লাইসেন্স পেয়েছে ১৯ লাখ চালক। কারণ অনেক চালকের একাধিক লাইসেন্স রয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি, ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুসারে, দেশে কমপক্ষে ১০ লাখ অননুমোদিত যানবাহন আছে। এসবের মধ্যে সিএনজিচালিত তিন চাকার গাড়ি পাঁচ লাখ। বিআরটিএতে অনুমোদন আছে দুই লাখ ৪২ হাজার ৮৮২টির। বাকিগুলোর নিবন্ধনই নেই। ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ খোকন বালেন, গ্রামাঞ্চলে চলাচল করা গ্যাস ও ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর বিপরীতে বৈধ চালক আছে প্রায় ৫০ হাজার। বাকিগুলো চলছে বৈধ চালক ছাড়াই। তিনি জানান, ঢাকায় শহরে ভাড়ায় চালানোর জন্য ১৩ হাজার ৬৫২টি বৈধ অটোরিকশা আছে। এগুলোর বিপরীতে বৈধ চালক আছে প্রায় ১০ হাজার। কিন্তু একবেলা ও দুই বেলা চালানোর জন্য সব মিলে চালক আছে প্রায় ৩০ হাজার। এখানে লাইসেন্স ছাড়া চালক ২০ হাজার।
অনেক যাত্রীর অভিযোগ, যাদের গাড়ি চালানোর লাইসেন্স আছে তাদের সবাইকে সরকারিভাবে কিংবা মালিক সমিতির পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরার পরই চালকরা ‘রাস্তার রাজা’ বনে যায়। গত শনিবার রাত আড়াইটায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বিশ্বম্ভরদীতে সুগন্ধা পরিবহনের ৪৫ আসনের একটি বাস খাদে পড়লে আটজনের প্রাণহানি ঘটেছে। জানা গেছে, ওই বাসের চালক ছিলেন জাহাঙ্গীর হোসেন।
বৃহত্তর দক্ষিণবঙ্গ কোচ বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী ২০টি পরিবহন কম্পানির একটি হলো সুগন্ধা পরিবহন কম্পানি। চালক জাহাঙ্গীর ১৩ বছর ধরে বাস চালিয়ে আসছেন। তাঁর বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার পখিয়ায়। বাসটির মালিক আবদুস সালাম কয়েক মাস আগে মারা গেছেন। বাস থেকে উদ্ধার হওয়া যাত্রীরা জানিয়েছে, চালক জাহাঙ্গীর মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। দ্রুতগতিতে চালানোর ফলে একটি খেজুরগাছ, একটি বাঁশঝাড় ও একটি শিশুগাছ ভেঙে পড়ে। দ্রুতগতির বাসটি একটি ট্রাককে অতিক্রম করতে গেলে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস নিয়ে খাদে উল্টে পড়েন। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা পরিষদের ২০১৫ সালের সিদ্ধান্ত অনুসারে, মহাসড়কে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ গতিবেগ হবে ৮০ কিলোমিটার। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানা মহাসড়ক পুলিশের ওসি মো. ইজাজুল ইসলাম জানান, ওই বাসটি নির্দিষ্ট গতির চেয়ে বেশি গতিতে চালাচ্ছিলেন চালক।
বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) নুর মোহাম্মদ মজুমদার কালের খবরকে বলেন, ‘বিআরটিএ সদর কার্যালয়ে নির্বাহী হাকিমের পদ আছে ১০টি। এখন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছেন চারজন। জেলা প্রশাসকরা বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালান। আমরা অভিযান না চালালে সড়কে অপরাধ আরো বাড়ত। নতুন আইন হলে এর প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। ’
ঝুলে আছে নতুন আইন : গত বছর মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া নতুন সড়ক পরিবহন আইনের খসড়ায় চালকের লাইসেন্স পেতে শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত আছে। বিভিন্ন অপরাধে বিদ্যমান মোটরযান আইনের চেয়ে বেশি মেয়াদে জেল ও বেশি জরিমানার প্রস্তাব রয়েছে তাতে। এ জন্য শীর্ষস্থানীয় পরিবহন নেতারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন, যাতে আইনটি পাস না করা হয়। ট্রাকচাপা দিয়ে মানুষ হত্যার অপরাধে ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে গত বছর ধর্মঘটে গিয়েছিল পরিবহন শ্রমিকরা।
নতুন আইনের খসড়াটি ভেটিংয়ের জন্য আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আছে বলে জানা গেছে।
খসড়া আইনে সড়ক দুর্ঘটনার দায়ে কঠিন শাস্তির প্রস্তাব এবং গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। চালকের সহকারী হতে হলেও লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করে এ জন্য অন্তত পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ হওয়ার শর্ত আছে। বিদ্যমান মোটরযান অধ্যাদেশে সহকারীদের লাইসেন্সের শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত নেই। প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। মোটরযান অধ্যাদেশে এ জন্য তিন মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে। চালকের সহকারীর লাইসেন্স না থাকলে এক মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখার কথা বলা হয়েছে নতুন আইনের খসড়ায়। নতুন আইন পাস হলে কেউ গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবে না। এ আইন ভাঙলে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। খসড়া মতে, ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে, এমন অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় চালকদের গ্রেপ্তার করতে পারবে।
কালের খবর -/৪/৪/১৮